ব্ল্যাক হোলের রহস্য উন্মোচন: তাদের গঠন, প্রকার এবং রহস্য
ব্ল্যাক হোল, এলিয়ন এইরকম মহাকাশের বিষয়গুলো নিয়ে হলিউড সিনেমা থেকে আমরা পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা দিচ্ছি। অনেকেই বলে থাকে ব্ল্যাক হোল এর ভেতরে একটি জগৎ আছে। একটি সিনেমাতে দেখিয়েছে যে, সেখান থেকে মানুষ তার নিজ নিজ অতীত দেখতে পারে। এই রহস্যময় মহাজাগতিক সত্তাগুলির একটি অকল্পনীয় মহাকর্ষীয় টান রয়েছে যা কেবল কাছে আসা সমস্ত কিছুকেই গ্রাস করে না বরং মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বোঝার চ্যালেঞ্জও করে।
ব্ল্যাক হোল হল সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা এবং ভুল বোঝানো বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলির মধ্যে একটি। অভিনব ছবিগুলি মানুষকে সবচেয়ে উদ্ভট উপায়ে ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করেছে। তাহলে ব্ল্যাক হোল আসলে কি? তারা কিভাবে গঠিত হয়? ব্ল্যাক হোল কত প্রকার? আমরা কি সেখানে যেতে পারি? আমরা যদি একটি ব্ল্যাক হোলে পড়ে যাই তাহলে কী হবে? ব্ল্যাকহোল কি একদিন আমাদের মহাবিশ্বকে ধ্বংস করবে? এই ব্লগ পোস্টে, আমরা ব্ল্যাক হোলের গোপন রহস্য জানবো।
১০০ বছর আগেও মানুষ এ বিষয়ে কিছু জানতো না। আইনস্টাইনের থিওরি অফ রেলিটিভিটির মাধ্যমে পরবর্তীতে ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে মানুষ জানতে পারলো। তবে এই থিওরির দুটি অংশ, একটি হলো স্পেসিয়াল থিওরি অফ রেলিটিভিটি, অন্যটি হলো জেনারেল থিওরি অফ রেলিটিভিটি। আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে স্পেসিয়াল থিওরি অফ রেলিটিভিটি প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে গতি সময়কে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ মহাকাশযানে আপনি খুব দ্রুত গতিতে যাচ্ছেন, সেখানে আপনার কাছে সময় কিছুটা ধীরে চলবে, পৃথিবীতে বাস করা মানুষের তুলনায়। কিন্তু সেটা আপনি বুঝতে পারবেন যখন আপনি পৃথিবীতে ফিরে আসবেন।
আবার মহাকর্ষ শক্তির জন্যও সময় ধীরে চলতে পারে, গ্রাভেটি যত বেশি, সময় তত ধীরে চলবে। যা আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অফ রেলিটিভিটি থেকে ১৯১৫ সালে জানা যায়। বিষয়টি তখন শুধু থিরোরির ভেতর ছিল। খোদ আইনস্টাইন নিজেও মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এমন বস্তুর অস্তিত্ব বর্তমান আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহে ছিলেন।
পরবর্তীতে দেখা যায়, ব্ল্যাক হোল এর আশেপাশের গ্রহতে সময় অনেক ধীরে চলছে, তা শুধু মাত্র ওই ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষ শক্তির ফলে।
তিনি সেখানে আরো বলেন যে, মহাকর্ষ শক্তি আগুন, শব্দ ও আলোকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ এটি খালি আমাদের ওজনকেই বাড়ায় না আলোর মতন শক্তিকেও প্রভাবিত করে।
এখন এমন শক্তি আছে এই মহাবিশ্বে যে কিনা আলোকেও হজম করে ফেলতে পারে অন্ধকারে। অর্থাৎ কালো হয়ে যায়, সেই অন্ধকার দিয়ে আলো বের হতে পারে না, যাকে আমরা ব্ল্যাক হোল নামে চিনি।
পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন বিজ্ঞানী ওই থিওরি গবেষণা করে জানান যে, ব্ল্যাক হোল জাতীয় বিশ্বে কিছু থাকতে পারে। ১৯৬০ সালের দিকে বিজ্ঞানীরা জানান যে, বিষয়টি শুধু থিওরিক্যালিই নয় বরং মহাকাশে ব্ল্যাক হোল আছে। খুব তাড়াতাড়ি তা আবিষ্কার হবে।
একটি ব্ল্যাক হোল কি?
ব্ল্যাক হোলের প্রকৃতি বোঝার জন্য, আমাদের প্রথমে মহাকর্ষীয় ধ্বংস এর বিষয় এ একটু জানতে হবে। যখন একটি বিশাল নক্ষত্র তার জীবনচক্রের শেষ প্রান্তে পৌঁছায়, তার ভেতরের গ্যাসের বিক্রিয়ার শক্তি শেষ হয়ে যায় তখন একটি বিপর্যয়মূলক ঘটনা ঘটে, অর্থাৎ আমাদের ভাষায় তেল শেষ হয়ে যায়। যার ফলে ওই নক্ষত্র এর ভেতরে একটি অবিশ্বাস্যভাবে তীব্র মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র সহ একটি কম্প্যাক্ট বস্তু তৈরি হয়। ব্ল্যাক হোল নামে পরিচিত এই বস্তুটির একটি মহাকর্ষীয় টান এতটাই শক্তিশালী যে এমনকি আলোও এটিকে এড়াতে পারে না, এটিকে আমাদের প্রচলিত পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিতে অদৃশ্য করে দেয়। তবে খুব বড় আকৃতির নক্ষত্র ছাড়া ব্ল্যাক হল সৃষ্টি করতে পারে না।
ব্ল্যাক হোলের প্রকারভেদ
ব্ল্যাক হোলকে তিনটি প্রধান প্রকারে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে: স্টারলার ব্ল্যাক হোল, ইন্টারমিডিয়েট-ম্যাস ব্ল্যাক হোল এবং সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল। বিজ্ঞানীরা ১০ মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন স্টারলার ব্ল্যাক হোল মহাকাশে আছে বলে অনুমান করে। ইন্টারমিডিয়েট-ম্যাস ব্ল্যাক হোল থিওরিক্যাল্লি জানা যায়, কিন্তু এখনো একে দেখা যায় নাই।
সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল সব থেকে বড় হোল, যা প্রায় আমাদের সৌরজগতের সমান বা তারও বড়। বিজ্ঞানীরা বলে যে, প্রত্যেক সৌরজগতের কাছে এমন একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল আছে, আমাদের সব থেকে কাছের ব্ল্যাক হোল এর নাম স্যাগিটরিয়াস এ।
অজানা যাত্রা: আমরা সেখানে যেতে পারি?
ব্ল্যাক হোলের কাছে চরম মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, তীব্র বিকিরণ এবং প্রচন্ড ঘূর্ণন গতি। যা অনেকটা নদীর মাঝের ঘূর্ণনন, যাকে আমরা বলে থাকি পাক, তেমন। তবে সেখানের প্রচন্ড গতির কারণে গ্যাসের বিক্রিয়ার ফলে প্রচন্ড তাপের সৃষ্টি হয়, যা আমাদের বর্তমান প্রযুক্তির সময় সৃষ্টিকৃত সকল জিনিসকে গলিয়ে দিতে পারে। সেখানে তীব্র এক্স-রে আলোর সৃষ্টি করে যা অনেকটা সাদা-নীলাভ রঙের হয়। যে আলোর অস্ত্বিত্ব আছে কিন্তু আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। ক্যামেরায় ২০১৯ সালে প্রথম ব্ল্যাক হোল এর ছবি তুলা যায়। সেখানে আলোর উপস্থিতি বুঝানোর জন্য কমলা রংকে আলো হিসেবে দেখানো হয়। ওই আলোর ভেতরে শেষ প্রান্তে, হোলের চার পাশে একটি চিকন আলোর রিংকেল রেখা দেখা যায়, যাকে ফ্রুটন বলা হয়।
ফ্রুটন কি? ফ্রুটন হলো আলো সৃষ্টিকারী উপাদান। যা সর্বোচ গতিতে ঘুরছে, চরম মহাকর্ষ আকর্ষণের কারণে। এর পরেই আসে ইভেন্ট হরাইজন নামের ব্ল্যাক হোলের বাউন্ডারি। এটাকে বাউন্ডারি বলার কারণ হচ্ছে এর পর গ্রাভেটি এতো শক্তিশালী হয়ে থাকে যে, আলো আর বেঁচে বের হতে পারে না।
ব্ল্যাক হোলে পড়া কি বিপদজনক ?
যদি আমরা একটি ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্তের খুব কাছাকাছি যেতে পারি, তাহলে মহাকর্ষীয় টান এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে যে আমরা পদার্থের একটি দীর্ঘ, পাতলা স্ট্র্যান্ডে প্রসারিত হব, একটি প্রক্রিয়া যা “স্প্যাগেটিফিকেশন” নামে পরিচিত। বিশাল জোয়ারের শক্তি আমাদের দেহের প্রতিটি পরমাণুকে ছিঁড়ে ফেলবে, নিশ্চিত করবে যে কোনও মানুষ এই ধরনের মুখোমুখি হতে পারবে না।
ব্ল্যাক হোলস এবং মহাবিশ্বের ভাগ্য
ব্ল্যাক হোলের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব তীব্র জল্পনা-কল্পনার বিষয়। যদিও ব্ল্যাক হোলগুলি নিজেরাই মহাবিশ্বের জন্য সরাসরি হুমকি সৃষ্টি করে না, ক্রমশ সঞ্চিত হওয়া এবং সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলগুলির চূড়ান্ত একত্রীকরণ মহাজাগতিক ল্যান্ডস্কেপকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। উপরন্তু, হকিং রেডিয়েশনের মত তাত্ত্বিক ধারণাগুলি প্রস্তাব করে যে ব্ল্যাক হোলগুলি ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে ভর এবং শক্তি হারায়, সম্ভাব্যভাবে তাদের চূড়ান্ত বাষ্পীভবনের দিকে নিয়ে যায়। যাইহোক, এই ধারণাগুলি এখনও তদন্তাধীন, এবং অনেক কিছু বোঝার বাকি আছে।
উপসংহারে, ব্ল্যাক হোলগুলি তাদের অপার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এবং রহস্যময় প্রকৃতির সাথে আমাদের বিভ্রান্ত করে । তাদের গঠন, প্রকারভেদ, তাদের পরিদর্শনের সম্ভাবনা, পরিণতি এবং মহাবিশ্বের সম্ভাব্য প্রভাবগুলি অন্বেষণের মাধ্যমে আমরা কেবল এই মহাজাগতিক রহস্যের পৃষ্ঠটি একটু একটু করে আগাচ্ছি। ব্ল্যাক হোলের রহস্য উদঘাটনের অনুসন্ধান নিঃসন্দেহে অব্যাহত থাকবে, বৈজ্ঞানিক কৌতূহলকে চালিত করবে এবং মহাজাগতিক সম্পর্কে আমাদের বোঝার সীমানা ঠেলে দেবে।